Header Ads

Logo Design by FlamingText.comLogo Design by FlamingText.com

সাহাবীদের সুন্নাতের অনুসরন

 
সুন্নাতের পক্ষে

সাহাবায়ে কেরামের জীবনে সুন্নাতের গুরুত্ব

প্রথমত, সকল ইবাদত ও জাগতিক কর্মে তাঁর পরিপূর্ণ অনুসরণ
সাহবায়ে কেরামের জীবন ছিল ‘সুন্নাত’ কেন্দ্রিক। আগেই বলেছি, এই গ্রন্থে আমরা ‘সুন্নাত’ কে মূল ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করছি। আমরা ‘সুন্নাত’ বলতে রাসূলুল্লাহ ()-এর সামগ্রিক জীবন পদ্ধতি ও কর্মরীতি বোঝাচ্ছি। সাহাবায়ে কেরামের যুগে এই অর্থই প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁদের সামনে রাসূলুল্লাহ -এর সুন্নাতই ছিল একমাত্র আদর্শ ও সফলতার একমাত্র পথ। রাসূলুল্লাহ -এর প্রতি প্রেম, ভালবাসা, ভক্তি ও তাঁর অনুসরণে তাঁরা ছিলেন আপোষহীন ও অতুলনীয়। সুন্নাতের প্রতি তাঁদের এই অতুলনীয় আপোষহীনতা আমরা দুই দিক থেকে পর্যালোচনা করতে পারি। প্রথম দিক হলো, জীবনের সকল দিকে সকল কাজে রাসূলুল্লাহ -এর অনুসরণ করার ক্ষেত্রে তাঁদের আপোষহীনতা। জীবনের ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়েও তাঁরা তাঁর অনুসরণ করতেন। ইবাদত বন্দেগির ক্ষেত্রে তাদের আপোষহীন অনুসরণের উদাহরণ লিখতে হলে বহু খণ্ডের একটি বই লিখতে হবে। আমি এখানে অতি সাধারণ জাগতিক বিষয়ে তাঁদের অনুসরণের দু’একটি নমুনা পেশ করছি :

(১). কোনো যুক্তি বা অজুহাতে তাঁর শিক্ষার বাইরে না যাওয়া

عَنْ مُجَاهِدٍ عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ : لا تَمْنَعُوا النِّسَاءَ مِنَ الْخُرُوجِ إِلَى الْمَسَاجِدِ بِاللَّيْلِ فَقَالَ ابْنٌ لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ: لا نَدَعُهُنَّ يَخْرُجْنَ فَيَتَّخِذْنَهُ دَغَلا [لِحَوَائِجِهِنَّ]. قَالَ فَزَبَرَهُ ابْنُ عُمَرَ وَقَالَ أَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ وَتَقُولُ: لا نَدَعُهُنَّ. وفي رواية: فَضَرَبَ فِي صَدْرِهِ وَقَالَ أُحَدِّثُكَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ، وَتَقُولُ لا!. وفي بعضها: فسبه، وغضب، وقال: فعل الله بك وفعل.
তাবেয়ী মুজাহিদ বলেন: আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা) বলেন: রাসূলুল্লাহ বলেছেন: “মেয়েদেরকে রাতে (জামাতে সালাত আদায়ের জন্য) মসজিদে যেতে বাধা দেবে না।” তখন ইবনু উমরের এক ছেলে বলল: আমরা মেয়েদেরকে মসজিদে যেতে দিব না; কারণ তারা মসজিদে যাওয়ার নামে বের হওয়াকে তাদের নষ্টামির সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করবে। তখন ইবনু উমর রাগান্বিত হন এবং ছেলেকে গালাগালি করে তার বুকে আঘাত করে বলেন: আমি বলছি রাসূলুল্লাহ বলেছেন, আর তুমি বলছ আমরা তাদের যেতে দেব না!”
সুবহানাল্লাহ! কোনো যুক্তি বা অজুহাতেই তাঁর সুন্নাত বর্জন করতে তাঁরা রাজি ছিলেন না। নিজের তবীয়তে বা প্রকৃতিতে ভালো না লাগলেও অকুণ্ঠচিত্তে তাঁর আনুগত্য করতে হবে। তাঁর শিক্ষার বাইরে যাওয়া যাবে না।
 ঠিক একই কারণে তাঁর পিতা খলীফা উমর ইবনু খাত্তাব (রা.) নিজ স্ত্রীকে মসজিদে যেতে নিষেধ করতেন না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি মেয়েদের ঘরে নামায আদায় করাকেই বেশি পছন্দ করতেন। কিন্তু যেহেতু রাসূলুল্লাহ তাদেরকে মসজিদে গমন থেকে বিরত রাখতে নিষেধ করেছেন, তাই তিনি কখনো নিষেধ করতেন না।

আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন : 

كَانَتْ امْرَأَةٌ لِعُمَرَ تَشْهَدُ صَلاةَ الصُّبْحِ وَالْعِشَاءِ فِي الْجَمَاعَةِ فِي الْمَسْجِدِ فَقِيلَ لَهَا لِمَ تَخْرُجِينَ وَقَدْ تَعْلَمِينَ أَنَّ عُمَرَ يَكْرَهُ ذَلِكَ وَيَغَارُ قَالَتْ وَمَا يَمْنَعُهُ أَنْ يَنْهَانِي قَالَ يَمْنَعُهُ قَوْلُ رَسُولِ اللَّهِ : لا تَمْنَعُوا إِمَاءَ اللَّهِ مَسَاجِدَ اللَّهِ. وفي رواية: إِنَّ عَاتِكَةَ بِنْتَ زَيْدٍ وَكَانَتْ تَحْتَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَكَانَتْ تَشْهَدُ الصَّلاَةَ فِيْ الْمَسْجِدِ وَكَانَ عُمَرُ يَقُوْلُ لَهَا وَاللهِ إَنَّكِ لَتَعْلَمِيْنَ مَا أُحِبُّ هَذَا فَقَالَتْ وَاللهِ لاَ أَنْتَهِيْ حَتَّى تَنْهَانِي قَالَ إِنِّي لاَ أَنْهَاكَ (وَاللَّهِ لأَخْرُجَنَّ إِلا أَنْ تَمْنَعَنِي فَلا يَمْنَعُهَا) قَالَتْ: فَلَقَدْ طُعِنَ عُمَرُ يَوْمَ طُعِنَ وَإِنَّهَا لَفِيْ الْمَسْجِدِ.
উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর স্ত্রী আতিকা বিনত যাইদ নিয়মিত মসজিদে জামাতে নামায (এক বর্ণনায়: ফজর ও ইশার নামায) আদায় করতেন। উমর (রা.) তাঁকে বলতেন, তুমিতো জানো যে, আমি এ কাজ (মেয়েদের নিয়মিত মসজিদে নামায আদায়) ভালবাসি না। তখন তাঁর স্ত্রী বলতেন: আপনি আমাকে নিষেধ না করা পর্যন্ত আমি এ থেকে বিরত হব না। যতদিন আপনি আমাকে নিষেধ না করবেন ততদিন আমি যাব। উমর (রা.) বলেন, আমি তোমাকে নিষেধ করছি না। যেহেতু রাসূলুল্লাহ বলেছেন যে, তোমরা মেয়েদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করবে না, সেহেতু তিনি নিষেধ করতেন না। এজন্য তাঁর স্ত্রীও নিয়মিত জামাতে গমন বন্ধ করেননি। (উমার (রা)-এর শেষ জামাত) যেদিন তিনি (আবু লুলু কর্তৃক) ছুরিকাহত হলেন সেদিনের সে জামাতেও আতিকা (রা.) উপস্থিত ছিলেন।”

(২). সকল যুক্তির ঊর্ধ্বে শুধু রাসূলুল্লাহর () অনুসরণে ইবাদত পালন

عن ابن عمر أَنَّ عُمَرَ ابْنَ الْخَطَّابِ قَالَ لِلرُّكْنِ: أَمَا وَاللَّهِ إِنِّي لأَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ اسْتَلَمَكَ مَا اسْتَلَمْتُكَ فَاسْتَلَمَهُ ثُمَّ قَالَ فَمَا لَنَا وَلِلرَّمَلِ؟ إِنَّمَا كُنَّا رَاءَيْنَا بِهِ الْمُشْرِكِينَ وَقَدْ أَهْلَكَهُمُ اللَّهُ ثُمَّ قَالَ: شَيْءٌ صَنَعَهُ النَّبِيُّ فَلا نُحِبُّ أَنْ نَتْرُكَهُ.
ইবনু উমর (রা.) বলেন : উমর ফারুক (রা.) কাবা শরীফ তাওয়াফের সময় হাজারে আসওয়াদকে সম্বোধন করে বলেন : আমি নিশ্চিতরূপেই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র, কোনো রকম কল্যাণ-অকল্যাণের, উপকার বা ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা তোমর নেই। যদি নবীজী তোমাকে চুম্বন না করতেন তাহলে কখনই আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না। এরপর তিনি হাজারে আসওয়াদকে চুম্বন করেন। এরপর তিনি বলেন : তাওয়াফের সময় দৌড়ানোর আর কী প্রয়োজন? আমরা তো মুশরিকদের ভয় দেখানোর জন্য এভাবে তাওয়াফ করেছিলাম। আল্লাহ তো মুশরিকদেরকে ধ্বংস করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন : একটি কাজ, রাসূলুল্লাহ করেছেন (কোনো যুক্তি বা প্রয়োজন না থাকলেও) আমরা তা পরিত্যাগ করতে চাই না। (আমরা রাসূলুল্লাহ -এর পদ্ধতিতে দৌড়ে দৌড়ে তাওয়াফ করব)।”
عَنْ زَيْدِ بْنِ أَسْلَمَ قَالَ رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يُصَفِّرُ لِحْيَتَهُ بِالْخَلُوقِ فَقُلْتُ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمَنِ إِنَّكَ تُصَفِّرُ لِحْيَتَكَ بِالْخَلُوقِ قَالَ إِنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ يُصَفِّرُ بِهَا لِحْيَتَهُ وَلَمْ يَكُنْ شَيْءٌ مِنَ الصِّبْغِ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْهَا وَلَقَدْ كَانَ يَصْبُغُ بِهَا ثِيَابَهُ كُلَّهَا حَتَّى عِمَامَتَهُ.
যাইদ ইবনু আসলাম বলেন : আমি ইবনু উমর (রা.)-কে দেখলাম যা’ফরান মিশ্রিত সুগন্ধ ‘খালূক’ খেযাব দ্বারা তাঁর দাড়ি হলুদ রঙে খেযাব করেছেন। তাকে প্রশ্ন করলে বললেন : আমি রাসূলুল্লাহ -কে এভাবে খেযাব দিয়ে হলুদ করতে দেখেছি। তাঁর কাছে এর চেয়ে প্রিয় রঙ আর কিছুই ছিল না। তিনি এই রঙ দিয়ে তার সকল পোশাক এমনকি পাগড়ি পর্যন্ত রঙ করে নিতেন।”
এভাবে তাঁরা তাঁর অনুসরণ করেছেন। কোনো যুক্তি নয়, কারণ নয়, কেন করেছেন, কী প্রয়োজন ইত্যাদি প্রশ্ন নয়। যেহেতু তিনি করেছেন তাই তাঁরই মতো করতে হবে। আর যা তিনি বর্জন করেছেন তা বর্জন করতে হবে, কেন বর্জন করেছেন বা কী যুক্তিতে তা জানার কোনো প্রয়োজন নেই।

(৩). কর্মে, বর্জনে, ইবাদতে ও মুআমালাতে অবিকল তাঁরই অনুসরণ
তাবেয়ী নাফে’ (রাহ.) বলেন :
رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يُصَلِّي إِلَى بَعِيرِهِ وَقَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ يَفْعَلُهُ
“আমি আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা.)-কে দেখলাম তিনি তাঁর উটকে কিবলার দিকে রেখে উটের দিকে মুখ করে (উটকে সুতরা বানিয়ে) নামায পড়ছেন। (কারণ হিসাবে) তিনি বলেন : “আমি রাসূলুল্লাহ -কে এরূপ করতে দেখেছি।”

উবাইদুল্লাহ ইবনু জুরাইজ আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা.)-কে বলেন, 

يَا أَبَا عَبْدِالرَّحْمَنِ رَأَيْتُكَ تَصْنَعُ أَرْبَعًا لَمْ أَرَ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِكَ يَصْنَعُهَا قَالَ وَمَا هِيَ يَا ابْنَ جُرَيْجٍ قَالَ رَأَيْتُكَ لا تَمَسُّ مِنَ الأَرْكَانِ إِلا الْيَمَانِيَّيْنِ وَرَأَيْتُكَ تَلْبَسُ النِّعَالَ السِّبْتِيَّةَ وَرَأَيْتُكَ تَصْبُغُ بِالصُّفْرَةِ وَرَأَيْتُكَ إِذَا كُنْتَ بِمَكَّةَ أَهَلَّ النَّاسُ إِذَا رَأَوُا الْهِلالَ وَلَمْ تُهِلَّ أَنْتَ حَتَّى كَانَ يَوْمُ التَّرْوِيَةِ قَالَ عَبْدُاللَّهِ: "أَمَّا الأَرْكَانُ فَإِنِّي لَمْ أَرَ رَسُولَ اللَّهِ يَمَسُّ إِلا الْيَمَانِيَّيْنِ وَأَمَّا النِّعَالُ السِّبْتِيَّةُ فَإِنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ يَلْبَسُ النَّعْلَ الَّتِي لَيْسَ فِيهَا شَعَرٌ وَيَتَوَضَّأُ فِيهَا فَأَنَا أُحِبُّ أَنْ أَلْبَسَهَا وَأَمَّا الصُّفْرَةُ فَإِنِّي رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ يَصْبُغُ بِهَا فَأَنَا أُحِبُّ أَنْ أَصْبُغَ بِهَا وَأَمَّا الإِهْلالُ فَإِنِّي لَمْ أَرَ رَسُولَ اللَّهِ يُهِلُّ حَتَّى تَنْبَعِثَ بِهِ رَاحِلَتُهُ.
আমি আপনাকে ৪টি কাজ করতে দেখেছি যা আপনার অন্যান্য সঙ্গী করেছেন বলে আমি দেখিনি। তিনি বলেন: সেগুলো কী? আমি বললাম: (১) আমি দেখি আপনি তাওয়াফের সময় শুধু কাবাঘরের দক্ষিণ দিকের দুই কোণা - হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী স্পর্শ করেন, অন্য কোনো স্থান স্পর্শ করেন না, (২) আপনি পশমহীন চামড়ার জুতা পরেন, (৩) আপনি হলুদ খেযাব বা রঙ ব্যবহার করেন এবং (৪) আপনি যখন মক্কায় থাকেন মক্কার মানুষেরা জিলহাজ্ব মাসের চাঁদ দেখলেই হজ্বের এহরাম করে নেয়, অথচ আপনি ৮ তারিখের আগে এহরাম করেন না। ইবনু উমর (রা.) বলেন : কাবাঘরের তাওয়াফের সময় আমি রাসূলুল্লাহ -কে দক্ষিণ দিকের দুই রুকন (কোণ) ছাড়া অন্য কোনো স্থান স্পর্শ করতে দেখিনি এজন্য আমিও শুধু এই দুই কোণই স্পর্শ করি। আমি রাসূলুল্লাহ -কে পশমহীন চামড়ার জুতা পরতে এবং এই জুতা পায়ে ওযু করতে দেখেছি, এজন্য আমিও এই ধরনের জুতা পরিধান করতে পছন্দ করি। আমি রাসূলূল্লাহﷺ  -কে হলুদ খেজাব বা রঙ ব্যবহার করতে দেখেছি, এজন্য আমিও তা ব্যবহার করতে ভালবাসি। হজ্বের এহরামের বিষয় হচ্ছে যে, আমি রাসূলুল্লাহ -কে  দেখেছি, তিনি ৮ ই জিলহজ্জ উটের পিঠে আরোহণ করে মিনা অভিমুখে যাত্রা শুরুর আগে হজ্বের এহরাম করেননি, এজন্য আমিও এর আগে এহরাম করি না।”
এখানে লক্ষ করুন, জায়েয নাজায়েযের বিষয় নয়, ফরয বা নফল চিন্তা নয়, একমাত্র চিন্তা কর্মে ও বর্জনে রাসূলুল্লাহ -এর অনুসরণ করা। তিনি যা যেভাবে করেছেন তা ঠিক সেভাবেই করা। তিনি যা বর্জন করেছেন তা বর্জন করা। অন্য যে যাই করুক না কেন। তিনি যেহেতু আগে এহরাম করেননি সেহেতু আগে এহরাম শত জায়েয হলেও তা করার কথা তিনি চিন্তা করতেন না। কাবা শরীফের অন্যান্য রুকন বা স্তম্ভ স্পর্শ করা রাসূলুল্লাহ বর্জন করেছেন, তাই তা জায়েয হলেও তিনি বর্জন করবেন।

(৪). রাসূলুল্লাহ যা বর্জন করেছেন তা বিনা যুক্তিতে বর্জন করা
যাইদ ইবনু আসলাম বলেন :
رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يُصَلِّي مَحْلُوْلٌ أَزْرَارُهُ، فَسَأَلْتُهُ عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ: رَأَيْتُ النَّبِيَّ يَفْعَلُهُ.
আমি ইবনু উমর (রা.) কে দেখলাম জামার বোতাম খুলে নামায আদায় করছেন। আমি এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন : “আমি নবীজী -কে এভাবে নামায আদায় করতে দেখেছি।”
عن عروة عن مُعَاوِيَة بْنُ قُرَّةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ: أَتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ فَبَايَعْتُهُ وَإِنَّ زِرَّ قَمِيصِهِ لَمُطْلَقٌ. قَالَ عُرْوَةُ: فَمَا رَأَيْتُ مُعَاوِيَةَ وَلا ابْنَهُ فِي شِتَاءٍ وَلا صَيْفٍ إِلا مُطْلَقَةً أَزْرَارُهُمَا.
তাবেয়ী উরওয়া আরেক তাবেয়ী মুয়াবিয়া ইবনু কুররা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর আব্বা সাহাবী কুররা ইবনু ইয়াস বলেছেন : “যখন আমি রাসূলুল্লাহ -এর নিকট এসে বাইয়াত করলাম, তখন তাঁর জামার বোতাম খোলা ছিল।” উরওয়া বলেন : আমি শীত হোক বা গ্রীষ্ম হোক কখনই এই সাহাবী কুররা বা তাঁর পুত্র মুয়াবিয়াকে জামার বোতাম লাগান অবস্থায় পাইনি। সর্বদাই তাঁরা জামার বোতাম খুলে রাখতেন।”
সুবহানাল্লাহ! অতি সাধারণ জাগতিক বিষয় ! এমনকি রাসূলুল্লাহﷺ  কোনো কারণে বা ইচ্ছে করে বোতাম খুলে রেখেছিলেন না অজান্তে বোতাম খোলা ছিল কিনা তাও বুঝা যায় না। কিন্তু ভালবাসা ও ভক্তি সাহাবীগণকে কিভাবে সর্বাত্মক অনুকরণে উদ্ভুদ্ধ করত তা আমরা এ সব ঘটনায় দেখতে পাচ্ছি। তিনি বোতাম লাগান বর্জন করেছিলেন। কেন করেছিলেন তা সাহাবীর প্রশ্ন নয়। তা বর্জন করা জায়েয অথবা নাজায়েয তা বিবেচ্য নয়। কোনো যুক্তি দিয়ে তা করার চেষ্টা নয়। শুধু তাঁর অনুসরণ করার আগ্রহ। তিনি করেননি আমিও করব না।

(৫). রাসূলুল্লাহ ﷺ    যা খেতে পছন্দ করতেন সাহাবীগণও তা পছন্দ করতেন
রাসূলুল্লাহ -এর খাদেম আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন :
إِنَّ خَيَّاطًا دَعَا رَسُولَ اللَّهِ لِطَعَامٍ صَنَعَهُ، قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِك: فَذَهَبْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ إِلَى ذَلِكَ الطَّعَامِ، فَقَرَّبَ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ خُبْزًا وَمَرَقًا فِيهِ دُبَّاءٌ وَقَدِيدٌ، فَرَأَيْتُ النَّبِيَّ يَتَتَبَّعُ الدُّبَّاءَ مِنْ حَوَالَيِ الْقَصْعَةِ، قَالَ: فَلَمْ أَزَلْ أُحِبُّ الدُّبَّاءَ مِنْ يَوْمِئِذٍ.
একদিন একজন দর্জি রাসূলুল্লাহ ()-কে খানা প্রস্তুত করে খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়। আনাস (রা) বলেন : আমিও রাসূলুল্লাহ -এর সাথে গেলাম। দাওয়াতকারী রাসূলুল্লাহ -এর সামনে রুটি এবং  লাউ ও শুকানো নোনা গোশত দিয়ে রান্না করা ঝোল তরকারি পেশ করে। আমি রাসূলুল্লাহ -কে দেখলাম খাঞ্চার ভিতর থেকে লাউয়ের টুকরোগুলি বেছে বেছে নিচ্ছেন। আনাস বলেন : ঐদিন থেকে আমি নিজে সর্বদা লাউ পছন্দ করতে থাকি।”
এখানে লক্ষণীয় যে, পানাহারের রুচি সাধারণত একান্তই ব্যক্তিগত হয়। একজন অপরজনকে ভালবাসলেও পানাহারের রুচিতে ভিন্নতা থেকে যায়। অন্যের রুচি অনুসারে পানাহার করলেও মনের অভিরুচি নিজের থেকেই যায়। আনাস ইবনু মালিক (রা.) এর কথায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাসূলুল্লাহ -এর প্রতি তাঁর ভালবাসা ও ভক্তির প্রচণ্ডতা এতই বেশি ছিল যে, তাঁর ব্যক্তিগত আহারের রুচিও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি একথা বলছেন না যে, সেই দিন থেকে তিনি বেশি করে লাউ খেতেন, বরং তিনি বলছেন যে, সেই দিন থেকে তিনি লাউ খাওয়াকে বেশি পছন্দ করতে ও ভালবাসতে শুরু করলেন। এই ছিল সাহাবীদের ভালবাসা, ভক্তি ও অনুসরণের নমুনা।

(৬). ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জাগতিক কাজেও তাঁরই অনুসরণের আপ্রাণ চেষ্টা করা

“ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত,
كَانَ يَأْتِيْ شَجَرَةً بَيْنَ مَكَّةَ وَالْمَدِيْنَةِ فَيَقِيْلُ تَحْتَهَا، وَيُخْبِرُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ كَانَ يَفْعَلُ ذَلِكَ.
তিনি (হজ্জ-উমরার সফরের সময়) মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে একটি গাছের কাছে যেতেন এবং তার নিচে দুপুরের বিশ্রাম (কাইলুলা) করতেন। তিনি বলতেন : রাসূলুল্লাহ () সেখানে এভাবে বিশ্্রাম করতেন।”
عَنْ مُجَاهِدٍ قَالَ كُنَّا مَعَ ابْنِ عُمَرَ فِي سَفَرٍ فَمَرَّ بِمَكَانٍ فَحَادَ عَنْهُ فَسُئِلَ لِمَ فَعَلْتَ فَقَالَ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ فَعَلَ هَذَا فَفَعَلْتُ.
মুজাহিদ বলেন, আমরা এক সফরে ইবনু উমরের (রা.) সঙ্গী ছিলাম। তিনি এক স্থানে পথ থেকে একটু সরে ঘুরে গেলেন। তাকে প্রশ্ন করা হলো : আপনি এমন করলেন কেন? তিনি বললেন : “আমি রাসূলুল্লাহ -কে এরূপ করতে দেখেছি তাই আমি এরূপ করলাম।”
সুবহানাল্লাহ! দেখুন অনুকরণের নমুনা। নিতান্ত জাগতিক কাজ, পথ চলতে হয়তো কোনো কারণে রাসূলুল্লাহ একটু ঘুরে গিয়েছিলেন। কোনোরূপ ইবাদত বা সফরের আহকাম হিসাবে নয়, কোনো সাওয়াবের কারণ হিসাবেও নয়। একান্তই ব্যক্তিগত জাগতিক বিষয়। তা সত্ত্বেও প্রেমিক ভক্তের অনুসরণের ঐকান্তিকতা দেখুন।


অন্য ঘটনায় তাবেয়ী আনাস ইবনু সিরীন বলেন :

كُنْتُ مَعَ ابْنِ عُمَرَ بِعَرَفَاتٍ فَلَمَّا كَانَ حِينَ رَاحَ رُحْتُ مَعَهُ حَتَّى أَتَى الإِمَامَ فَصَلَّى مَعَهُ الأُولَى وَالْعَصْرَ ثُمَّ وَقَفَ مَعَهُ وَأَنَا وَأَصْحَابٌ لِي حَتَّى أَفَاضَ الإِمَامُ فَأَفَضْنَا مَعَهُ حَتَّى انْتَهَيْنَا إِلَى الْمَضِيقِ دُونَ الْمَأْزِمَيْنِ فَأَنَاخَ وَأَنَخْنَا وَنَحْنُ نَحْسَبُ أَنَّهُ يُرِيدُ أَنْ يُصَلِّيَ فَقَالَ غُلامُهُ الَّذِي يُمْسِكُ رَاحِلَتَهُ إِنَّهُ لَيْسَ يُرِيدُ الصَّلاةَ وَلَكِنَّهُ ذَكَرَ أَنَّ النَّبِيَّ لَمَّا انْتَهَى إِلَى هَذَا الْمَكَانِ قَضَى حَاجَتَهُ فَهُوَ يُحِبُّ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتَهُ.
আমি একবার হজ্বের সময় আব্দুল্লাহ ইবনু উমরের (রা.) সাথে ছিলাম। দুপুরে তিনি আমাদেরকে নিয়ে আরাফাতের ময়দানে গমন করেন এবং ইমামের সাথে যোহর ও আসরের নামায আদায় করেন। এরপর তিনি ইমামের সাথে আরাফাতে অবস্থান করেন।  আমি ও আমার কিছু সঙ্গীও সাথে ছিলাম। সন্ধ্যায় ইমাম আরাফাতের ময়দান ত্যাগ করে মুযদালিফার দিকে রওয়ানা দিলে তিনিও আমাদেরকে নিয়ে রওয়ানা দিলেন। আমরা যখন মুযদালিফার দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সংকীর্ণ স্থানে পৌঁছলাম তখন তিনি উট থামিয়ে অবতরণ করলেন। তাঁকে দেখে আমরাও আমাদের উট থামিয়ে নেমে পড়লাম। আমরা ভাবলাম তিনি এখানে (মাগরিব ও এশার) নামায আদায় করবেন। তখন তাঁর উটের চালক খাদেম আমাদেরকে বলল : তিনি এখানে নামায আদায় করবেন না। কিন্তু তিনি বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ যখন এ স্থানে পৌঁছান, তখন প্রাকৃতিক হাজত পূরণ করে ইস্তিঞ্জা করেন, তাই তিনিও এখানে হাজত সারতে বা ইস্তিঞ্জা করতে পছন্দ করেন।”

সাহাবীদের জীবনের এ ধরনের ঘটনা লিখতে গেলে বড় বই হয়ে যাবে। হাফিজ আব্দুল আযীম মুনযিরী  (৬৫৬ হি.) এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: “সাহাবীদের থেকে সুন্নাতের এরূপ অনুসরণের ঘটনায় বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা খুবই বেশি।”

(৭) ইবাদত ও জাগতিক সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ -এর পূর্ণ অনুসরণ

বর্তমান সময়ে যারা রাসূলুল্লাহ -এর জাগতিক অভ্যাস বা পানাহার, পোশাক পরিচ্ছদ, চলাফেরা ইত্যাদি সুন্নাতকে অবজ্ঞা করেন বা এসব বিষয়ে কোনো ‘সুন্নাত’ নেই বলে মনে করেন তাদের এ সকল ঘটনাগুলি চিন্তা করা দরকার। বস্তুত রাসূলুল্লাহ -এর জাগতিক ও মানবীয় কর্মও ‘সুন্নাত’-এর মর্যাদায় সমাসীন। তাঁর ইবাদতকে ইবাদত হিসাবে, জাগতিক অভ্যাসকে জাগতিক অভ্যাস হিসাবে অনুকরণ করাই ‘সুন্নাত’। সার্বিক অনুকরণ আমাদের মধ্যে পরিপূর্ণ মহব্বত ও ভক্তি সৃষ্টি করবে। তেমনি তাঁর প্রতি আমাদের সত্যিকার ভালবাসা ও ভক্তি থাকলে তা আমাদের এইরূপ দ্বিধাহীন পরিপূর্ণ অনুসরণের দিকে ধাবিত করবে।
সমাজে যারা এ ধরণের জাগতিক বা প্রাকৃতিক সুন্নাতের অনুসরণ করতে দ্বিধা করেন, নিজের রুচি অভিরুচিকে রাসূলুল্লাহ -এর রুচি অভিরুচির উপরে স্থান দিয়ে একেক ধরনের অজুহাত দেখিয়ে একেক ধরনের ‘সুন্নাত’ পরিত্যাগ করেন, অথচ তাঁর প্রেমিক ও ভক্ত অনুসারী বলে দাবি করেন তাদেরও এখানে একটু থমকে দাঁড়ান দরকার।
অপরদিকে আমাদের সমাজে অনেক ভক্ত প্রেমিক রাসূলুল্লাহ -এর জাগতিক অভ্যাসমূলক সুন্নাতগুলিকেই গুরুত্বসহকারে পালন করেন। অথচ যে সকল কাজ তিনি নিজে ‘সুন্নাত’ হিসাবে শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহর নৈকট্যের মাধ্যম হিসাবে পালন করেছেন, হয়তোবা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সে সকল সুন্নাত পালনের ক্ষেত্রে বিশেষ ত্র“টি ও অবহেলা তাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, রাসূলুল্লাহ যে কাজ যেভাবে, যতটুকু গুরুত্বসহকারে, যে পদ্ধতিতে করেছেন বা বর্জন করেছেন, সেই কাজ সেভাবে, ততটুকু গুরুত্বসহকারে, সেই পদ্ধতিতে করা বা বর্জন করাই সুন্নাত। প্রকার, পদ্ধতি বা গুরুত্বের ক্ষেত্রে বেশি-কম করা সুন্নাতের খেলাফ। মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদেরকে তাঁর খলীল ও হাবীব নাবীয়ে উম্মীর () পূর্ণ অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের মতো ভক্তি, ভালবাসা ও অনুসরণের তৌফিক দান করুন। দয়া করে আমাদেরকে তাঁদেরই দলভুক্ত করে হাশরে উঠান এবং জান্নাতের নেয়ামত দান করুন ; আমীন।

No comments

Powered by Blogger.